মাহফুজ বাবু।।
কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ভারেল্লা উত্তর ও দক্ষিণ ইউনিয়ন এলাকা। এক সময় গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, আর নানা জাতের সবজি ও ফসল সহ সবুজের সমারোহে সুজলা সুফলা গোমতী ঘেঁষা এলাকটি আদর্শ গ্রামীণ জনপদ ছিলো এই এলাকা। প্রাকৃতিক জীব বৈচিত্র্য লীলাভূমি গ্রামীণ এই জনপদ দিন দিনই যেন বিষাক্ত হয়ে উঠছে। বাণিজ্যিক বা শিল্পাঞ্চল না হলেও কৃষি নির্ভর বুড়িচংয়ের রামপুর, পরুয়ারা, কংশনগর সহ আশেপাশের প্রায় ৪ থেকে ৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকার আকাশ জুড়ে বিষাক্ত কালো ধোঁয়া, বাতাসে ওড়ে ছাই, ভূষি সহ অর্ধশতাধিক অটো রাইস মিল ও ব্রিকস ফিল্ডের বিষবাষ্প।
পরিবেশ আইনের তোয়াক্কা নেই। নেই আবাসিক এলাকার জনস্বাস্থ্য ও প্রাকৃতিক জীব বৈচিত্র্য রক্ষার বালাই। ৪ থেকে ৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকার বিস্তির্ণ কৃষি জমি ও জনবসতি ঘেঁষে গড়ে উঠেছে ছোট–বড় স্বয়ংক্রিয় বা আধা স্বয়ংক্রিয় প্রায় ৪০টিরও অধিক চালকল বা অটো রাইস মিল। সেই সাথে আছে রাইস বার্নিং ওয়েল মিল ও ইটের ভাটা।
টাকা, রাজনৈতিক প্রভাব বা ওপর মহলের তদবির হলেই মিলছে ছারপত্র বা অনুমোদন। আবাসিক এলাকা কিংবা কৃষি চাষাবাদের আদর্শ ভুমিই হোক, সেসবের কোন তোয়াক্কা নেই সংশ্লিষ্ট দপ্তরের। আর এসব চালকলের বর্জ্যে নষ্ট হচ্ছে জমির ফসল, দূষিত হচ্ছে খাল, বিল ও পুকুর । চালকলের ধোঁয়া ও ছাইয়ে গাছপালার পাতায় পরেছে মোটা আস্তরণ। সবুজ প্রকৃতি ছেয়ে গেছে এসব কল কারখানার কালো ছাই ও ফ্লাই এ্যাশে। গাছে ফলন হচ্ছে না, জমির ফসল হচ্ছে বিলিন। শত ও পরিচর্যা করেও পরিশ্রমের ফসল মিলছেনা। এলাকার বয়স্ক ও শিশুদের পাশাপাশি তরুণ শিক্ষার্থীরা ভুগছেন শ্বাসকষ্ট, চোখের সমস্যা সহ নানান রোগে ।
গত দু’দিন আগেই কংশনগর পশ্চিমপাড়া এলাকার কৃষক শরিফ উদ্দিন সরু মিয়া নিজ বাড়ি কাছেই ব্রাদার্স অটো রাইস মিলের পাশ দিয়ে জমিতে যাওয়ার সময় মিলের বাইরের উত্তপ্ত ছাইয়ের মাঝে পড়েন। শরিফের আর্তনাদে আশেপাশের লোকজন দৌড়ে আসে। উদ্ধার করে দ্রুত নেয়া হয় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। অবস্থার অবনতি হলে নেয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ডাক্তারের বরাত দিয়ে পরিবারের সদস্যরা জানায় শরীরের প্রায় ৬০ শতাংশই ঝলসে গেছে তার। বর্তমানে শেখ হাসিনা বার্ণ হাসপাতালের আইসিইউতে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছে সে। একই এলাকার স্থানীয় আরেক ভুক্তভোগী আবু তাহের অভিযোগ করে বলেন, মিলের ছাই ও তুষের কারনে একটি চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। আরেকটি চোখেও এখন ভালো ভাবে দেখতে পান না। ডাক্তার দেখিয়েও অনেক অর্থও খরচ করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পরিবেশের নিয়মনীতি মেনে স্থাপন করা হয়নি বেশীর ভাগ মিল কারখানা। আর এ কারণেই কারখানার গরম পানি, ছাই ও দূষিত বর্জ্যে আবাদি জমি, ফসল, খাল ও পুকুরের পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হচ্ছে।
কংশনগর এলাকার এসব চালকলের সব বর্জ্য ও পানি ফেলা হচ্ছে বুড়িচং ও দেবিদ্বার এলাহবাদ খাল সহ আশেপাশের ফসলের জমিতে। মিলের বর্জ্যে দুষিত ও বিষাক্ত হয়ে গেছে পানি, পারুয়ারা ও এলাহবাদ এলাকার খালগুলোর বিভিন্ন অংশ ভরাটও হয়ে গেছে মিলের দুষিত বর্জ্যে।
কিছু মিলের ভিতরে ঢুকেও দেখা যায় , শ্রমিকরা কাজ করছেন। শ্রমিকদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতার কোন বালাই নেই। তাঁদের মুখমণ্ডলে কালো ছাইয়ের আস্তর পড়ে আছে। সকলের না থাকলেও, যেসব মিলের পরিবেশ ও খাদ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন আছে সেসব মিলেরও বর্জ্য পরিশোধনের যথাযথ ব্যবস্থা নেই। তাই চালকলের সব বর্জ্য ফেলা হচ্ছে ফসলের জমি, সড়কের পাশের উন্মুক্ত স্থান ও খালবিলে। চুল্লি দিয়ে ধোঁয়ার সঙ্গে তুষের ছাই ও ফ্লাই এ্যাশ চারদিকে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়ছে।
কৃষক বজলু মিয়া বলেন, মিলের কাছাকাছি ১০ মিনিট দাঁড়ানো যায় না। দিন রাত ছাই উড়তে থাকে পুরো এলাকায়। গাছপালার পাতা কালো হয়ে গেছে। গাছে নতুন করে কোনো ফল ধরে না। এলাকায় শিশু ও বৃদ্ধ সহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ চোখের সমস্যা ও শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে ভুগছে। এসব মিল এভাবে চলতে থাকলে এলাকায় বসবাস করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এলাকাট যুবকদের অনেকেই জানান, এমন ভাবে চলতে থাকলে আগামী পাঁচ বছরে কয়েকটি গ্রামের মানুষের অন্ধত্ব সহ চক্ষু রোগে ভুগতে হবে।
ভাই ভাই অটো এগ্রো রাইস মিল মালিক আব্দুস ছালাম এর কাছে জানতে চাইলে বলেন, ‘অটো রাইস মিল চালালে কিছু ক্ষতি তো হবেই, আবার উপকারও হবে। পরিবেশ দুষন বন্ধ করতে হলে জ্বালানী হিসেবে তুষের পরিবর্তে গ্যাস ব্যবহার করতে হবে। আমারা জেলা রাইস মিল মালিক সমিতের প্রতিনিধিরা বহু ভাবেই চেষ্টা করে যাচ্ছি গ্যাস সংযোগ নেয়ার জন্য। কিন্তু সেটা সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া সব নিয়ম মেনেই মিল করা হয়েছে। সবকিছুর অনুমোদনও আছে আমাদের। ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক শরিফের ঘটনাটি কি ভাবে হয়েছে তা বুঝতে পারছি না। তার চিকিৎসার খোজ খবর নিয়মিত নেয়া হচ্ছে। বিষয়টি দুঃখ জনক। আমরা তার চিকিৎসায় সহায়তা করবো’
পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রাখতে চালকলগুলোর নিজস্ব রিসাইক্লিং প্লান্ট করে চালাতে হবে, অন্যথায় আবাসিক ও কৃষি এলাকা থেকে অন্যত্র শিল্পাঞ্চলে স্থানান্তর করার দাবি স্থানীয় এলাকাবাসীর। মিলগুলো পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে চালানোর কথা বলে মালিকগণ ইউপি থেকে অনাপত্তি সনদ নেয়। মিলের উৎপাদন শুরুর পর এলাকাবাসী ইউপি চেয়ারম্যান সহ জনপ্রতিনিধিদের কাছে অভিযোগ জানায়, ছাই উড়ে ঘরবাড়ি, গাছপালা ও পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, খালে বিলে মিলের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট এলাকার ইউপি চেয়ারম্যানদের বক্তব্য, তাদের ক্ষমতার পরিধি সীমিত, তবে পরিবেশ ও খাদ্য অধিদপ্তর চাইলে অনিয়মে চলা মিলগুলো বন্ধ করতে পারে।
দেখা যায় বুড়িচং উপজেলায় চালকলগুলোর অধিকাংশেরই নেই কোন বর্জ্য পরিশোধনাগার। তাই কারখানার দূষিত বর্জ্য গিয়ে মিশছে ফসলি জমিতে। কারখানার দূষিত বর্জ্য গিয়ে মিশছে ফসলি জমিতে। চালকলগুলোর চারপাশেই ফসলি জমি। ব্রয়লারের হওয়ায় গরম পানি, ছাই ও দূষিত বর্জ্য ফেলা হয় চালকলের পাশের এসব জমি, খোলা জায়গায় এবং খালে।
মেসার্স জুলেখা এগ্রো ইন্ডাস্ট্রির পেছনে বসবাস করা বাসিন্দারা জানান ‘ছাই উড়ে অস্থির একটা অবস্থার মধ্যে আছি আমরা। জমিজমা সব শ্যাষ। রাতদিন শব্দের সমস্যা তো আছেই। ধুলাবালিতে কানা হয়ে যায় সব। গত কয়েক বছর ধরে নরক যন্ত্রণায় আছি আমরা। মেম্বার চেয়ারম্যান ও মিল মালিকদের বলেও কোন লাভ হয়নি। ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে রেখেও রেহাই নেই। রান্নার সময় মিলের ছাই এসে খাবার পড়ছে। রোগ বালাইয়ের কথা বলেও লাভ নাই। প্রতিবেশীদের কয়েকজন বাধ্য হয়ে বাড়ি ঘর বিক্রি করে অন্যত্র চলে গেছে। সত্যতা প্রমাণে বাড়িতে গিয়ে শূন্য বাড়ির দরজায় তালাও ঝুলিতে দেখা যায়
পারুয়ারা এলাকার মিল মালিকদের কয়েকজন জানান, তাঁরা শ্রম মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর, খাদ্য অধিদপ্তরসহ সব ধরনের লাইসেন্স নিয়ে মিল চালাচ্ছেন। তবে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে স্বীকার করে তারা বলেন, “ধীরে ধীরে আপডেট হচ্ছে কারখানাগুলো। তবে এখানকার কয়েকটি কারখানা এখনো পুরোনো পদ্ধতি ও মেশিন ব্যবহারের কারনে একটু বেশি ধোয়া ও ছাই পরিবেশে ছড়িয়ে পরছে। এসব মিলগুলিও আস্তে ধীরে পরিবর্তন করবে বলে মালিকরা জানিয়েছেন।”
কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, অটো রাইস মিলের ধোঁয়া ও ছাই পরিবেশ ও ফসলের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পরিবেশ ও খাদ্য অধিদপ্তরকে আরও দায়িত্বশীল হওয়ার কথা জানান।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয় সূত্র জানায়, চালকল করতে প্রথমে মালিক জমি নির্ধারণ করে কল স্থাপন করেন। পরে দলিলের কপি, বিদ্যুৎ বিলের কপি, পরিবেশের ছাড়পত্রসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিয়ে খাদ্য অধিদপ্তরের নির্ধারিত প্রকৌশলীর কাছে আবেদন করতে হয়।
এদিকে এসব বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরকে দায়ী করছে খাদ্য অধিদপ্তর। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রন সূত্রের দাবী ‘পরিবেশের ক্ষতি হলে তা দেখার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। তারাই পদক্ষেপ নেবে। তা ছাড়া পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া একটি অটো রাইস মিলেরও অনুমোদন দেয় না খাদ্য বিভাগ।’
জানতে চাইলে বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী কমকর্তা সাহিদা আক্তার বলেন, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে ফসলি জমি ও খাল বিল নদী দূষণ করে কোনো প্রতিষ্ঠান চালানো যাবে না। যাঁরা এসব চালকল চালাচ্ছেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে ওই কারখানার মালিকদের বারবার সতর্ক করা হয়।
বৃহস্পতিবার দুপুরে ব্রাদার্স এগ্রো ইন্ডাস্ট্রি পরিদর্শক করে পরিবেশ দুষণ, ফসলের ক্ষতি সহ বিভিন্ন অনিয়ম পাওয়া যায়। মোবাইল কোর্টের মাধ্যম ১লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড করা হয়। যদি ক্ষতির তুলানায় তা নগন্য। পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। এসব বিষয়ে পরিবেশ ও খাদ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত মনিটরিং করে যথাযথ নির্দেশনা না মানলে নিয়ম ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আবাসিক ও কৃষি এলাকায় এমন শিল্প কারখানা অনুমোদন দেয়া ঠিক নয় বলেই মনে করি। ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয়রা চাইলে আদালতে আইনি পদক্ষেপ নিতে পারে। আগুনে দগ্ধ কৃষক শরিফ এর চিকিৎসার যাবতীয় খরচ বহনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে মিল মালিক কে। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানকে এবিষয়ে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
আরো দেখুন:You cannot copy content of this page